নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের মুখোমুখি হয়ে থাকে বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চল। সিডর, আইলা, আম্পান, বুলবুল, ফনী, মোরা, রোয়ানু, কোমেন, মহাসেনের মত আলোচিত ও ভয়ংকরসব সুপার সাইক্লোন এশিয়া মহাদেশের যে অঞ্চলেই আঘাত হেনেছে তার প্রভাব এসে আছড়ে পড়েছে বাংলার শস্য ভান্ডার খ্যাত বরিশাল বিভাগে। ভৌগলিক অবস্থান অনুসারে বঙ্গোপসাগর লাগোয়া এই বিভাগের প্রধান বৈশিষ্ট নদী মাতৃকতা। তাই আবহাওয়ার সাথে মানুষের সখ্যতা রেখেই বাঁচতে হয়। নদীতীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন রোদ-ঝড়-বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে তেমনি বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়াও নির্ভর করে আবহাওয়া অফিসের সংকেতের ওপর। মূলত আবহাওয়ার সর্তকতা না পেলে এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়া করে টিকে থাকতে পারে না।
বাস্তবতা হলো, উপকূলীয় মানুষের রক্ষাকবচ বিভাগীয় শহর বরিশালের আবহাওয়া অফিসটি রয়েছে জরাজীর্নভাবে। লোকবল ও আবাসন সংকট, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সরবারহে অব্যবস্থাপনা; সর্বোপরি সংস্কারহীন আবহাওয়া অফিসটি দিনদিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। যাতে করে সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ।
বরিশাল বিভাগে এখন পর্যন্ত চারটি আবহাওয়া স্টেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। স্টেশনগুলো উপকূলীয় পটুয়াখালীর জেলা সদরে একটি, খেপুপাড়া উপজেলায় একটি, দ্বীপজেলা ভোলায় একটি এবং বরিশাল জেলায় একটি। উপকূলীয় আরও দুটি জেলা বরগুনা এবং পিরোজপুরে কোন আবহাওয়া অফিস নেই। মধ্য উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠিতেও নেই আবহাওয়া স্টেশন। ফলে ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা জেলার মানুষ সুদূর বরিশাল বিভাগের আবহাওয়া অফিস থেকে তথ্য জেনে থাকেন। তাছাড়া বৈরী আবহাওয়ায় অনেক সময়ে বাকি তিনটি আবহাওয়া স্টেশন মানুষ সংযুক্ত তথ্য না পেলে পুরো বিভাগের প্রায় এক কোটি জনসংখ্যাকে নির্ভর করতে হয় বরিশাল বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের ওপর। কিন্তু সেই অফিসে বিদ্যুৎ সংকট, সৌর বিদ্যুতের অভাব ও আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকা ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বশির আহম্মেদ বলেন, সংকট থাকা সত্যেও আমরা সার্বক্ষণিক চেষ্টা করছি আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য সরবারহ করতে। তবে কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেগুলোর উত্তরণ ঘটানো উচিত। এই কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও ইন্টানেট সেবা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের চালিকা শক্তি। কিন্তু বরিশাল বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসে ইন্টানেট এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সমস্যা কাটছেই না। যদিও সরকারি ইন্টারনেট সরবারহকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির সাথে কথা হয়েছে তাদের। কিন্তু কবে নাগাদ বিটিআরসির ব্রডব্যান্ড কানেকশন পাবেন তা এখনো নিশ্চিত নন।
জানা গেছে, আবহাওয়া অফিসে বর্তমানে ১২ জন কর্মরত রয়েছেন। দ্বায়িত্বরত ওই ১২ জনই কর্মকর্তা। যারমধ্যে একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন সহকারী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পাঁচজন উচ্চ পর্যবেক্ষক এবং পাঁচজন বেলুন মেকার। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় অফিসে সাধারণত জনবল কাঠামোতে রয়েছে একজন উপ-পরিচালক, দুইজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন সহকারী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পাঁচজন উচ্চ পর্যবেক্ষক, পাঁচজন বেলুন মেকার, দুইজন অফিস সহায়ক, নাইট গার্ড। অর্থাৎ এখনো পাঁচজন জনবলের প্রয়োজন। যারমধ্যে অফিস সহায়ক ও নাইট গার্ড ছাড়া পুরোপুরি অরক্ষিত থাকছে। তাছাড়া দায়িত্বরতদের জন্য নেই আবাসনের ব্যবস্থা। যদিও সম্প্রতি আবাসনের জন্য একটি ভবনের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু তা বর্তমান জনবলের জন্য অপ্রতুল। ফলে কর্মকর্তাদের ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে।উচ্চ পর্যবেক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বাবুল বলেন, বর্তমানে আবহাওয়ার সংকেত দিতে দুই ধরণের তথ্যের সমন্বয় করা হয়। প্রথমত রাডার ভিত্তিক ওয়েবসাইটের তথ্য এবং আমাদের অফিসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সরঞ্জামাদির ব্যবহারিক তথ্য। কিন্ত এখানে অত্যান্ত ধীর গতির ইন্টানেট হওয়ায় তাৎক্ষণিক তথ্য সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া অফিসে সরবারহ করতে হিমশিম খেতে হয়। বরিশাল বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসে এখনো মডেম ব্যবহার করে ইন্টারনেট সংযুক্ত হতে হয়। এতে ২-জি গতিসীমা পাওয়া যায়। আব্দুল কুদ্দুস বাবুল বলেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন পেলে আবহাওয়া পর্যবেক্ষন সুবিধার হবে এবং তাৎক্ষণিক তথ্য সরবারহ করা যায়।
ওদিকে ব্যবহারিক সরঞ্জাম পর্যবেক্ষণে বৈদ্যুতিক আলো অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু অফিসে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই; সংযোগ নেই বিদ্যুতের একাধিক লাইনের। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে অফিসে মোমের আলোয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের কাজ করতে হয়। আর আবহাওয়া অফিস এলাকায় ১৩টি বিদ্যুতের লাইটপোস্ট রয়েছে, যেখানে সিটি কর্পোরেশন থেকে বাতি সরবারহ করার কথা থাকলেও তারা না দেয়ায় আবহাওয়া অফিসে কর্মরতদের বেতনের টাকায় লাইটপোস্টে বাতি জ্বালাতে হয় বলে জানান উচ্চ পর্যবেক্ষক আব্দুল কুদ্দুস বাবুল। জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকার বরিশাল-লাখুটিয়া সড়কে অবস্থিত আবহাওয়া অফিসটি যে ভবনে সেটি স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয়। ফলে সময়ের সাথে সাথে কমে গেছে ভবনের সক্ষমতা। ভবনের অধিকাংশ স্থান থেকে খসে পড়েছে পলেস্তরা। দরজাগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় বেধে রাখা হয়েছে কোনমতে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বশির আহম্মেদ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি নতুন ভবন বরাদ্দ পাওয়ার। এজন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ হয়েছে। আশা করি অনতিবিলম্বে বরিশাল আবহাওয়া অফিসের উন্নয়নে বরাদ্দ পাওয়া যাবে।
Leave a Reply